চতুর্থ পরিচ্ছেদ মাছের অভয়াশ্রম

নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - কৃষি শিক্ষা - কৃষি উপকরণ | | NCTB BOOK
5

নদী মাতৃক আমাদের এই বাংলাদেশে রয়েছে অসংখ্য ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের অভ্যন্তরীণ জলাশয় যার মোট আয়তন হচ্ছে প্রায় ৪৭ লক্ষ হেক্টর এবং আরও রয়েছে ১.৬৬ লক্ষ বর্গ কিমি এর সুবিশাল বঙ্গোপসাগর । বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের শতকরা প্রায় ৮৮ ভাগই হচ্ছে মুক্ত জলাশয় যেমন- নদ-নদী, বিল, সুন্দরবনের জলাভূমি, কাপ্তাই লেক, হাওর ও প্লাবনভূমি । যার মোট আয়তন হচ্ছে ৪০.২৫ লক্ষ হেক্টর । অন্যদিকে বদ্ধ জলাশয় রয়েছে মাত্র শতকরা প্রায় ১২ ভাগ যার মধ্যে রয়েছে পুকুর, দিঘি, ডোবা, হাওর ও চিংড়ি খামার । এদের মোট আয়তন হচ্ছে ৬.৭৮ লক্ষ হেক্টর । বাংলাদেশে বর্তমানে মোট মাছ উৎপাদনের শতকরা ৮০ ভাগ আসে অভ্যন্তরীণ জলাশয় হতে এবং ২০ ভাগ আসে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ হতে ।
সুদূর অতীতে প্রাকৃতিকভাবে এদেশের অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়সমূহে বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর মাছ ধরা পড়ত । ষাটের দশকে এর পরিমাণ ছিল মোট মৎস্য উৎপাদনের ৮০% । বিগত কয়েক দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অতিরিক্ত পানি ব্যবহার, কৃষিকাজে কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার, শিল্পায়নের ফলে পানি দূষণ, অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ, নির্বিচারে ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ নিধন, নদীতে অপরিকল্পিত বাঁধ ও অবকাঠামো নির্মাণ এবং পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার কারণে বর্তমানে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় হতে এ উৎপাদন নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৫% এ । বাকি উৎপাদনের ৪৭% আসে বিভিন্ন বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ থেকে এবং ১৮% আসে সামুদ্রিক মৎস্য হতে । মুক্ত জলাশয়ে শুধু উৎপাদনই নয় সে সাথে মাছের জীববৈচিত্র্যও দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে । ইতোমধ্যে বাংলাদেশে মোট ২৬০ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছের মধ্যে ১২টি চরম বিপন্ন, ২৮টি বিপন্ন ও ১৪টি ঝুঁকিপূর্ণ প্রজাতি হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। যে প্রজাতি প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে অচিরেই বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকি মোকাবেলা করছে তাকে চরম বিপন্ন প্রজাতি (যেমন- সরপুঁটি, মহাশোল, বাঘাআইড়), আর যে প্রজাতি অদূর ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হবার ঝুঁকি মোকাবেলা করছে তাকে বিপন্ন প্রজাতি বলে । অন্যদিকে যে প্রজাতি বিপন্ন না হলেও মধ্যমেয়াদি ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তাকে ঝুঁকিপূর্ণ প্রজাতি বলে । বাংলাদেশের কয়েকটি বিপন্ন প্রজাতির মাছের উদাহরণ হচ্ছে- রানি, পাবদা, টেংরা ইত্যাদি । আর ঝুঁকিপূর্ণ প্রজাতি হচ্ছে ফলি, গুলশা, কাজলি, মেনি ইত্যাদি । মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য মাছের নিরাপদ আবাসস্থল বা অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করা জরুরি । মৎস্য অভয়াশ্রম হচ্ছে কোনো জলাশয় বা এর একটি নির্দিষ্ট অংশ যেমন- কোনো হাওর, বিল বা নদীর কোনো অংশ যেখানে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে বা সারা বছর বা দীর্ঘমেয়াদের জন্য অথবা স্থায়ীভাবে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। অনেক সময় উক্ত নির্দিষ্ট স্থানে মাছ আহরণ যেন না করা যায় এজন্য গাছের ডালপালা, বাঁশ ইত্যাদি স্থাপন করা হয়। এতে করে সেখানে মাছ নিরাপদ আশ্রয় পায়, মুক্তভাবে বিচরণ করতে পারে ও অবাধ প্রজনন ঘটাতে পারে । বর্তমানে দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ও অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে প্রায় ৫০০টির মতো অভয়াশ্রম পরিচালনা করা হচ্ছে ।

মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপনের গুরুত্ব

১. মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপনের বা ঘোষণার মাধ্যমে মাছের নিরাপদ আবাসস্থল নিশ্চিত করা যায় ।

২. মাছের অবাধ প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র সংরক্ষণ এবং সম্প্রসারণ করা যায় ।

৩. মাছের নিরাপদ আশ্রয় তৈরির মাধ্যমে বিলুপ্ত প্রায় বা মাছের বিপন্ন প্রজাতি সংরক্ষণ করা যায় ।

৪. মাছের বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাদ্য নিশ্চিত করা যায় ।

৫. প্রজননক্ষম মাছকে রক্ষার মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি ও মজুদ বৃদ্ধি করা যায় ।

৬. জলজ পরিবেশে মাছের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা যায় ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা মৎস্য অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরি করবে ।

নতুন শব্দ : চরম বিপন্ন প্রজাতি, বিপন্ন প্রজাতি, ঝুঁকিপূর্ণ প্রজাতি, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়
 

Content added By
Promotion